সাহিত্য একাডেমির মার্চ মাসের সাহিত্য আসর অনুষ্ঠিত
বেনজির শিকদার:
প্রবাস নিউজ
প্রকাশিত : ০৯:৪৩ এএম, ১১ এপ্রিল ২০২৪ বৃহস্পতিবার
২৯শে মার্চ, শুক্রবার ২০২৪- বিকেলে জ্যাকসন হাইটসের একটি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল 'সাহিত্য একাডেমি, নিউইয়র্ক'র নিয়মিত আয়োজন, মাসিক সাহিত্য আসর। আসরটি পরিচালনায় ছিলেন, একাডেমির পরিচালক মোশাররফ হোসেন।
শুরুতেই মহান মুক্তিযুদ্ধে শহিদ, নির্যাতিত দুইলক্ষ মা বোনের আত্মত্যাগ ও অসংখ্য মানুষের সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যে স্বাধীনতা এসেছে, সেই স্বাধীনতার প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম এবং বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করেছেন, সবার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয়।
কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘স্বাধীনতা, উলঙ্গ কিশোর’ কবিতাটি আবৃত্তির মধ্যদিয়ে আসরের শুভ সূচনা করা হয়। কবিতাটি আবৃত্তি করেন, আবৃত্তিশিল্পী আবীর আলমগীর।
সদ্যপ্রয়াত শিশুসাহিত্যিক হাসানুর রহমান এর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। তার সম্পর্কে লেখক এবিএম সালেহ উদ্দীন বলেন, গত ১৪ই মার্চ একটি রিহাব সেন্টারে তিনি ইন্তেকাল করেন। আমরা যারা অনেক আগে এদেশে এসেছি, প্রায় সবাই তাকে চিনি। তিনি যখন ঢাকায় ছিলেন, খুব সরব থেকে শিশুসাহিত্য নিয়ে কাজ করেছেন। তার মায়ের নাম ছিল দৌলতুন্নেসা সিঁড়ি। মাত্র আড়াইবছর বয়সে তার মাতৃবিয়োগ ঘটে। মায়ের স্মরণে ‘সিঁড়ি শিশুসাহিত্য কেন্দ্র’ নামে তিনি বাংলাদেশে একটি প্রতিষ্ঠান করেছিলেন। তার দশটি বই প্রকাশিত হয়েছে। সাহিত্য একাডেমির শুরু থেকেই তিনি নিয়মিতভাবে আসরগুলোতে আসতেন।
লেখক ও প্রাবন্ধিক আবেদীন কাদের ‘মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের সাহিত্য’ এই বিষয়ের ওপর আলোচনা করেন। আলোচনায় তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের দেশে গল্প কবিতা উপন্যাস রচিত হয়েছে ঠিকই কিন্তু এদের অধিকাংশ লেখক যুদ্ধের ময়দানে ছিলেন না। যুদ্ধ কেমন করে হয়েছে- খবরের কাগজ পড়ে, লোক-মুখে শুনে, এমনকি কল্পনার আশ্রয়ে তাদের লেখাগুলো লিখেছেন। লেখক ও উপন্যাসিক সেলিনা হোসেনের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ বইটি প্রসঙ্গে বলেন, এই বইটি আমি অনুবাদ করেছি, এটিও লেখকের অন্যের মুখে শুনে লেখা একটি উপন্যাস। উপন্যাস আসলে এমন একটি শিল্পমাধ্যম, যেটি মূলত নগরায়ণের ফসল। একটি সমাজে যদি নগরায়ণ না ঘটে তাহলে সেখানে কথাসাহিত্য সৃষ্টি হওয়া খুব কঠিন; আর হলেও সেগুলো দুর্বল হয়। তিনি বলেন, আমি উপন্যাসের ভাষাটিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান মনে করি। যেমন পশ্চিমবঙ্গের সাথে তুলনা করলে- তাদের সাম্প্রতিক উপন্যাসের ভাষা আর পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চাশ, ত্রিশ বা চল্লিশের দশকের উপন্যাসের ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা। এই যে ভাষার বিবর্তন; এভাবে ভাষা নিজেই একটা শিল্পকে অনেকখানি উত্তীর্ণ করে। সেরকমভাবে ব্যতিক্রমী ভাষায় বাংলাদেশে উপন্যাসের সংখ্যা কম। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন- আগামীদিনে তরুণদের ভেতর থেকে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনেক ভালো লেখা আমরা নিশ্চয়ই পাবো।
লেখক ও প্রাবন্ধিক হাসান ফেরদৌস আবেদীন কাদেরের আলোচনার সূত্র ধরে বলেন, ‘মীর মশাররফ হোসেনের লেখা উপন্যাস ‘বিষাদ সিন্ধু’ কারবালার গল্প নিয়ে লেখা। তিনি কখনও কারবালায় যাননি। মূলত লেখকের জন্মের একহাজার বছর আগে কারবালার ঘটনাটি ঘটেছিল। বইটি পড়ে আমরা এখনও কাঁদি। তিনি মনে করেন, লেখার জন্য একজন লেখককে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকতেই হবে তেমন নয়, যুদ্ধ নিজচোখে দেখতে পেলেই যে ভালো লেখা সৃষ্টি হবে তেমনও নয়। তিনি উল্লেখ করেন, মুক্তিযুদ্ধ একটি প্রক্রিয়া, যার শুরু ১৯৪৭ সালে। মুক্তিযুদ্ধের একটি সফল নাটক হচ্ছে মুনীর চৌধুরীর লেখা ‘কবর’। সাহিত্য হচ্ছে একটি চলমান প্রক্রিয়া আর এই প্রক্রিয়া প্রতিনিয়ত চলছে, চলবে। স্বাধীনতা পরবর্তী মাত্র পঞ্চাশ বছরে মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের সাহিত্যে যেভাবে উঠে এসেছে, পৃথিবীর অনেক দেশেই তাদের মুক্তির সংগ্রাম সেভাবে আসেনি। ২৬শে মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। যারা প্রবাসে আছি তারা একে ধারণ করতে চাইলে অবশ্যই ইতিহাস পড়তে হবে, জানার চেষ্টা করতে হবে।
আসরে বই নিয়ে আলোচনা করেন, লেখক আদনান সৈয়দ। তিনি ‘লেটারস টু এ্য ইয়ং পোয়েট’ এই বইটির ওপর আলোচনা করেন। বইটির লেখক- রাইনার মারিয়া রিলকে, তিনি জার্মান কবি। বইটি প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, সেনাবাহিনীতে কর্মরত তাপস নামক এক অনুজ- যার বয়স আঠারো, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হলেও সে কবিতা লিখতো। নতুন এই লেখকের সাথে একবার রিলকের চিঠি আদান প্রদান চলছিল। বিষয়— “কীভাবে লেখক হওয়া যায়?” আদনান সৈয়দ অনূদিত রিলকের একটি চিঠির অংশবিশেষ ছিল এমন—
“আপনি জানতে চেয়েছেন, আপনার কবিতার ছন্দ ঠিক আছে কিনা? বিষয়টি আপনি আমার কাছে জানতে চেয়েছেন, অনুমান করি আপনি এই কথাটি আগেও হয়তো অন্যকে বলে থাকবেন। হয়তো এই কবিতাগুলি আপনি কোনও সাহিত্য পত্রিকায় পাঠিয়েছেন, আপনি আপনার কবিতাগুলি হয়তো অন্য কবিতার সাথে তুলনা করেছেন এবং দুঃখ করেছেন, যখন দেখেছেন কোনও কোনও সম্পাদক আপনার কবিতাগুলোকে বাতিল করে দিয়েছেন। এখন, যেহেতু আপনি আমার উপদেশ শুনতে চেয়েছেন, আপনার প্রতি আমার করজোড় অনুরোধ- দয়া করে এ কাজ করা থেকে বিরত থাকুন। আপনি বাইরের জগৎটা কী এখন শুধু দেখেন, আপনার এই সৃষ্টিনেশা বন্ধ করতে হবে। কেউ আপনাকে উপদেশ দিতে পারবে না, কেউ আপনাকে থামাতে পারবে না। আপনার কাজ একটাই, নিজের অন্তরাত্মায় প্রবেশ করুন, আবিষ্কার করুন- কী সেই তাড়না; যা আপনাকে লেখার শক্তি জোগায়? আপনি নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন, যদি লেখালেখি না করতে পারি তাহলে মৃত্যু, রাতের নিস্তব্ধতায় নিজেকে প্রশ্ন করুন, আমার কি লেখা চালিয়ে যাওয়া উচিত? আর এই উত্তরের জন্য আপনি নিজেই গভীরভাবে খোঁড়াখুঁড়ি করুন।” এভাবেই বইটি এগিয়েছে। আদনান সৈয়দ বলেন, যারা লেখালেখির সাথে যুক্ত, এই বইটি তাদের জন্য বেশ ফলপ্রসূ হবে।
সাপ্তাহিক ঠিকানা পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা- এম এম শাহীন, যিনি এবারের আসরটি স্পন্সর করেছেন, তিনি বলেন- রোজার মাস হওয়া সত্ত্বেও একটি সাহিত্য আসরে বিপুলসংখ্যক সাহিত্যামোদী প্রাণের উপস্থিতি দেখে আমি সত্যিই খুব আনন্দিত ও অভিভূত! দীর্ঘ ৩৫বছরের পথ পরিক্রমায় প্রবাসের এত সংগ্রামী জীবনযাপন করেও যারা ঠিকানা পত্রিকায় লেখা দিয়ে পত্রিকাটি সম্মৃদ্ধ ও আলোকিত করছেন, তাদের প্রতি সম্মান শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আশারাখি আগামী দিনগুলোতেও সাহিত্য একাডেমির এই বিশাল কর্মযজ্ঞের সাথে জড়িয়ে থেকে নিজেকে সম্মৃদ্ধ করার চেষ্টা করবো।
আসরে উপস্থিত ছিলেন- ফেরদৌস সাজেদীন, মোহম্মদ ফজলুর রহমান, কাজী আতীক, আহমাদ মাযহার, হুসনে আরা, নাঈমা খান, সেলিমা আশরাফ, মেহফুজ আহমেদ, বিশ্বজিৎ সাহা, নীরা কাদরী, রানু ফেরদৌস, নীলুফার জাহান, ফরিদা ইয়াসমিন, মুমু আনসারী, মৃদুল আহমেদ, মিশুক সেলিম, আবু সাঈদ রতন, নাসির শিকদার, হাসানুজ্জামান সাকী, ধনঞ্জয় সাহা, প্রতাপ দাস, রিমন ইসলাম, রাহাত কাজী, পলি শাহীনা, পারভীন সুলতানা, শুক্লা রায়, আখতার আহমেদ রাশা, ফরহাদ হোসেন বাবু, ম্যারিষ্টিলা শ্যামলী আহমেদ, মোহাম্মদ আলী বাবুল, মনিজা রহমান, জেবুন্নেছা জোৎস্না, রিমি রুম্মান, লুৎফা শাহানা, ফারহানা হোসেন, মনিকা রায়, রওশন আরা নীপা, তাহমিনা শহীদ, এলি বড়ুয়া, সবিতা দাস, মুনমুন সাহা, আজিজুল হক মুন্না, ভায়লা সালিনা, মাসুম আহমেদ, ছন্দা বিনতে সুলতান, রুপা খানম, জুয়েদ আহমেদ, মিয়া আসকির, জয়া করীম, জাকির মিয়া, মেহের চৌধুরী, আকলিমা রানা চৌধুরী, আনিসুল কবীর জাসির, মহিবুর রহমান, সেলিম হারুন, মাসুম মোর্শেদ, মনিরা নূর, আয়েশা চৌধুরী, বিধান পাল, সিলু রহমান, জাকির হোসেন রনি, এনামুল করীম দীপু, শিবলী সাদীক, সোমা রোজারিও, জেরিন মাইশা, আলভান চৌধুরী, বেনজির শিকদার প্রমুখ।
যথারীতি এবারের আসরেও পাঠের জন্য বই বিতরণ করা হয়। একমাসের জন্য ধার নেওয়া বইগুলো হলো- সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’ আবু সায়ীদ আইয়ুবের ‘পান্থ জনের সখা’ এবং কাজী আবদুল ওদুদের ‘শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ’।
আসর শেষে মানবিক আলোকরেখার বিচ্ছুরণ আর সকলের সপ্রাণ উপস্থিতিতে সঘন ইফতার আয়োজনের সময়টুকু হয়ে উঠেছিল, এক নির্মল-প্রশান্তিময় নিসর্গশোভা। সবাইকে আগামী আসরের আমন্ত্রণ জানিয়ে, অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।