গিটার হাতে নিলেই ‘নিলয় দাশ ইজ অ্যা ডিফারেন্ট ম্যান’

প্রবাস নিউজ ডেস্কঃ

প্রবাস নিউজ

প্রকাশিত : ০২:২১ এএম, ২ অক্টোবর ২০২৪ বুধবার

নিলয় দাশের জন্মদিনে তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন লেখক-গবেষক মিলু আমান

বাদক নন, তিনি ছিলেন গিটার সাধক। বাংলাদেশের 'গিটারিস্টদের গিটারিস্ট' বলা হয় তাকে। গিটারের ছয় তারের জাদুতে তিনি মাতিয়ে রেখেছেন ঢাকা শহরের তারুণ্যকে। পাশ্চাত্য সংগীতের ক্ল্যাসিক্যাল, নিও ক্লাসিক্যাল, ফ্ল্যামেঙ্কো, জ্যাজসহ আরও কিছু ধারাকে পরিচিত করেছিলেন এদেশের সংগীতজগতে। তিনি এই শহরের সন্তান, এই শহরেরই মিথ—নিলয় দাশ, যিনি এখনো ফেরেন গিটারের ছয়তারে।

নব্বই দশকের গোড়ার দিকে কলাবাগানে নিলয় দাশের বাসা ছিল যেন ঢাকার গিটারিস্টদের 'ল্যাবরেটরি'। তার বাবা সুধীন দাশ উপমহাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংগীতজ্ঞ, নজরুল সংগীত গবেষক এবং মা নীলিমা দাশও ছিলেন প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী। 

আজ ৩০ সেপ্টেম্বর নিলয় দাশের ৬৩তম জন্মদিনে তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন লেখক-গবেষক মিলু আমান। লেখক হলেও সংগীতের নেশা ছাড়তে পারেননি মিলু আমান। বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীত, রক মিউজিক নিয়ে লিখেছেন বেশ কিছু বই। নিলয় দাশ স্মরণেও একটি সংকলন প্রকাশ করেছেন।

মিলু আমান যখন কিশোর, সদ্য এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন, ইচ্ছা ছিল সেই সময়টায় 'প্রিয় নিলয়দা'র কাছে গিটার বাজানোটা শিখে নেবেন। সাহস করে চলে গেলেন গিটার শিক্ষক নিলয় দাশের ক্লাসে। আর তারপরের এক দশক তো পুরো সময় তার সঙ্গে লেগে ছিলেন ছায়ার মতো। ২০০৬ সালে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে মারা যান আমাদের গিটারের মিথ নিলয় দাশ।

 

মিলু আমান। ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মিলু আমান জানিয়েছেন কেন নিলয় দাশ একটা মিথ, সংগীত নিয়ে তার ভাবনা, কীভাবে গিটার হয়ে উঠল তার জীবন, কতটা ভালবাসতেন গিটার বাজাতে।

ডেইলি স্টার: নিলয় দাশের সঙ্গে পরিচয় কীভাবে হলো?

মিলু আমান: গান-বাজনা, ওয়েস্টার্ন মিউজিকের প্রতি ভালোবাসা ছিল ছোটবেলা থেকেই।  ক্লাস সেভেন-এইট থেকেই ইচ্ছা ছিল গিটার শিখব। বাসায়ও বায়না করেছি গিটার কিনে দেওয়ার। আব্বার কড়াকড়ি থাকলেও ১৯৯০ সালে এসএসসি শেষে মা রাজী হলেন।

কিন্তু আমি তো গিটার চিনি না, কিনব কীভাবে। জানতাম আমাদের পাড়ায় বড় একজন গিটারিস্ট আছেন। আইয়ুব বাচ্চু, ওয়ারফেজের কমল ভাইসহ ঢাকার জনপ্রিয় প্রায় সব গিটারিস্টদের দেখতাম উনার কাছে আসতেন। লতিফুল ইসলাম শিবলী আসতেন, ফোয়াদ নাসের বাবু, আশিকুজ্জামান টুলু আসতেন।  আমিও ভাবলাম যাই নিলয় দা'র কাছে। দেখি বলি, গিটার কিনতে চাই শিখতে চাই।

 

নিলয় দাশ। ছবি: ইমতিয়াজ আলম বেগ

আমাদের পাড়াতেই একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ছুটির দিনে উনি গিটার শেখাতেন। আমিও একদিন চলে গেলাম। দারোয়ানকে বলে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। ক্লাসে গিয়ে তো আমি মুগ্ধ, পুরো ক্লাসরুমের সবাই গিটার বাজাচ্ছে। নিলয়দা এক ছাত্রের সঙ্গে কিছুক্ষণ জ্যাম (যুগলবন্দী) করলেন, অসাধারণ সেই মুহূর্ত। ক্লাস শেষে নিলয়দাকে বললাম আমি গিটার কিনতে চাই। উনি তো আমার দিকে অবাক হয়ে তাকালেন। বললেন, 'গিটার কিনবা তো আমার কাছে কেন, সায়েন্সল্যাব যাও। অনেক দোকান আছে সেখানে।' বললাম, গিটার চিনি না। একপর্যায়ে তাকে রাজিও করালাম। পরে ওইদিন বিকেলেই তাকে নিয়ে সায়েন্সল্যাবে গিয়ে গিটার কিনে ফেলি।

নিলয়দা শেখাতে খুব ভালোবাসতেন, এলেই নতুন কিছু শেখা যেত। এ ধারণা থেকে আমারও তার কাছে যাওয়া।

ডেইলি স্টার: মিউজিকের প্রতি নিলয় দাশের ভালোবাসা ছিল কতটা?

মিলু আমান: তার পরিবার ছিল পুরোপুরি সংগীত পরিবার। বাবা বাংলাদেশের প্রখ্যাত নজরুল সঙ্গীত গবেষক সুধীন দাশ, মা খুব ভালো গান গাইতেন, বোনও গান গাইতেন। সুধীন দাশ বাংলাদেশের অন্যতম সংগীতজ্ঞ, নজরুল সংগীতের স্বরলিপিকার, শিক্ষক ও গবেষক ছিলেন। মিউজিকের প্রতি ভালোবাসার ব্যাপারটা নিলয়দার ভেতরে মনে হয় ছোটবেলা থেকেই গড়ে উঠেছিল। বাবা-মায়ের মতো বাংলা ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকের দিকে না গেলেও, ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিক্যালের প্রতি তার ভালো লাগা ছিল। আমাদের ওই সময়টা ওয়েস্টার্ন মিউজিকের প্রতি তরুণদের একটা অন্যরকম ঝোঁক তৈরি হয়েছিল। নিলয় দাশও গিটার বাজানো শেখেন এবং গিটারের কাজ আছে এমন ওয়েস্টার্ন মিউজিকের বিভিন্ন ধারা নিয়ে কাজ শুরু করেন।

পরিচয়ের শুরুতেই তিনি কথা বলতে বলতে জেনেছিলেন যে আমি ছোটবেলা থেকেই অনেক গান শুনি। ওয়েস্টার্ন মিউজিকের বেশ ভালো একটা কালেকশনও আছে আমার। গিটার শেখার পাশাপাশি লিসেনার হিসেবে তার সঙ্গে গান শোনার একটা আলাদা সম্পর্ক ছিল আমার। ওই সময়টা আসলে বিভিন্ন ধরনের ওয়েস্টার্ন মিউজিকের অ্যালবাম সংগ্রহ খুব সহজ ছিল না। এলিফ্যান্ট রোডে একটা দোকান ছিল 'রেইনবো' সেখান থেকে গান সংগ্রহ করতাম, আরও বিভিন্ন জায়গা থেকে করতাম। অনেক কষ্টের কাজ ছিল এটা, সবাই চাইলেই পারত এমনও নয়। আমার এই বিষয়টা তিনি খেয়াল করেছিলেন। তাই আমার কাছে নিলয়দা বিভিন্ন গান, মিউজিক, বাইরের গিটার প্লেয়ারদের অ্যালবামের খোঁজ করতেন।

 

বুনোর সঙ্গে নিলয় দাশ। ছবি: ইমতিয়াজ আলম বেগ

নতুন কোনো অ্যালবাম পেলে সেটার খুঁটিনাটি জানায় তার অনেক আগ্রহ ছিল। আগে যে এলপি ছিল, ক্যাসেট ছিল সেগুলোর কাভারে গানের লিরিক, মিউজিশিয়ানদের নাম, ইনস্ট্রুমেন্ট, রেকর্ডিংয়ের বিভিন্ন তথ্য থাকত—সেগুলো বের করে করে তিনি পড়তেন।  

ডেইলি স্টার: নিলয় দাশের গিটার শেখা কীভাবে?

মিলু আমান: আমাদের ওই সময় গিটার শেখা খুব একটা সহজ ছিল না। আগেই বললাম যে পরিবার থেকে ছোটবেলাই হয়ত সংগীতে হাতেখড়ি। তারপর তার নানা ধরনের গান, মিউজিক শোনার আগ্রহ ছিল। সব ধরনের মিউজিক শুনতেন, গিটারের প্রতি আগ্রহ ছিল প্রবল। আমি যতটুকু শুনেছি, ঢাকায় কোনো এক কোরিয়ান ভদ্রলোকের কাছে নিলয় দাশ গিটারের প্রাথমিক কিছু লেসন নিয়েছিলেন।

তখন তেমন কোনো ভালো বই পাওয়া যেত না গিটার শেখার, আর বলা বাহুল্য সেসময় তো ইন্টারনেট বা ইউটিউব ছিল না। শুনে শুনে গান বা মিউজিক গিটারে তুলে তুলে শেখাটাই বেশি চর্চা করতেন সে সময়কার মিউজিশিয়ানরা। নিলয়দা বিভিন্ন ধরনের গিটার ওয়ার্ক শুনতেন। ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিক্যাল, ফিঙ্গারস্টাইল, ফ্ল্যামেঙ্কো তার পছন্দের প্যাটার্ন। শুনতেন প্যাকো ডি লুসিয়া, জন ম্যাকলাফিন, এল ডি মেওলার কাজ।  

শুনে শুনে বাজিয়ে বাজিয়ে, যে কীভাবে বাজালে ওই সাউন্ডটা বের হচ্ছে, সুরটা তৈরি হচ্ছে—এটাই ছিল সবার কমন প্র্যাকটিস। ক্যাসেট সামনে-পেছনে টেনে টেনে বারবার রিওয়াইন্ড-ফরওয়ার্ড করে শুনে শুনে এটা করতে হতো। আর এটার জন্য কান খুব ভালো হতে হতো, শোনারও একটা দক্ষতা আছে—যেটা খুবই ভালো ছিল নিলয়দা'র। প্রতিটা সাউন্ড খুব ডিটেইলে ধরতে পারতেন।

ডেইলি স্টার: নিলয় দাশকে অনেকে বলে 'গিটারিস্টদের গিটারিস্ট'। কেন বলে?

মিলু আমান: তিনি সারাক্ষণ গিটার নিয়েই থাকতেন। তাকে কখনো দেখিনি গিটার ছাড়া। তার বাসায়ও যারা আসতেন তাদের মধ্যে মিউজিকের বাইরের কোনো লোকজন দেখিনি, তাদের সঙ্গে কথাবার্তাও তার সব হতো মিউজিক নিয়ে, গিটার নিয়ে। আবার এমন না যে একটা ধারার মধ্যে আটকে থাকতেন। নতুন কিছু শুনতে চাইতেন সবসময়, এক্সপ্লোর করতে চাইতেন। আমার কালেকশন থেকেও তিনি ল্যাটিন, আফ্রিকান মিউজিক নিয়ে শুনে দেখতেন। আর ভালোবাসতেন শেখাতে। তার কাছে এলে নতুন কিছু না কিছু শেখা যেত। এটাই তাকে অন্য গিটারিস্টদের থেকে আলাদা করে তুলেছে। আর এ কারণে সে সময়কার ঢাকার সব গিটারিস্টদের নতুন কিছু শেখার জায়গা ছিল নিলয় দাশ। ছোট-বড়, বিখ্যাত, শিক্ষানবিশ সবাই আসত। কারও কিছু বেসিক শেখা বা নতুন কোনো ট্রিকস বা টেকনিক শেখা প্রয়োজন হলেই তার কাছে চলে আসত নির্দ্বিধায়। আর আমাদের পাড়ায় একটা গিটার স্কুল তো ছিলই তার, সাপ্তাহিক ছুটির দিনে গিটার শেখাতেন। তার কারণে আমাদের এই পাড়াটার নামও হয়ে গিয়েছিল 'গিটারপাড়া'।

ডেইলি স্টার: নিলয় দাশের গিটার শেখানোর পদ্ধতি কেমন ছিল?

মিলু আমান: তার গিটার শেখানোর স্টাইলটা ছিল খুবই ইউনিক। যথেষ্ট কড়া ছিলেন শেখানোর বিষয়ে। প্রথমে বেসিক কিছু বিষয় দিয়ে শুরু করতেন। হ্যামারিং, ফিঙ্গারিং করে হাত রেডি করা ছিল প্রথম লেসন। গিটার যেহেতু হাতে বাজায়, দুই হাতের কিছু বেসিক প্র্যাকটিস ছিল, যেগুলো কমপ্লিট না করলে নিলয়দা আর নতুন লেসন দিতেন না। তার কাছে শেখার শর্টকাট কোনো পথ ছিল না।

 

আমি যখন গিটার শিখতে গেলাম তার কাছে, ভাবলাম এবার তো আমার কোনো অসুবিধা নাই। অনেক কিছু শিখে ফেলব, বিখ্যাত গিটারিস্ট হয়ে যাব। কিন্তু গিয়ে যখন প্রথম লেসন নিলাম, সেটা এত কঠিন ছিল যে সেটা শেষ করে পরের ধাপে যেতেই অনেক কষ্ট হয়ে গেল। কর্ড শিখতে চাইলাম, দিলেন কড়া ঝারি। বললেন, 'বহু দেরি আছে। আগে এগুলো করো, হাত ফ্রি করো তারপর।'

স্টুডেন্টদের পটেনশিয়াল বুঝতে পারতেন তিনি, কার কোনটা ভালো, কে লিড গিটারিস্ট হলে ভালো করবে, কে ক্ল্যাসিক্যাল ভালো বোঝে। একটা বেসিকের পর সে অনুযায়ী লেসন চেঞ্জ হয়ে যেত।

 নিলয় দাশের ফেভারিট জনরা বা মিউজিশিয়ান?

মিলু আমান: আগেই বললাম যে তিনি বেশ ওপেন ছিলেন শোনার ক্ষেত্রে, কোথাও আটকে থাকতেন না। ওয়ার্ল্ড মিউজিকের যেকোনো ধারা বা ঘরানা নিয়ে তার আগ্রহ ছিল। তবে এর মধ্যে আমি যতদূর দেখেছি ক্ল্যাসিক্যালের প্রতি বেশ ভালো ঝোঁক ছিল। ইতালিয়ান ক্ল্যাসিক্যাল কম্পোজার পেগানিনির মিউজিকের ফ্যান ছিলেন। এছাড়া বেটোভেন, মোজার্ট, বাখ শুনতেন। রবিশঙ্কর আর আনন্দশঙ্করের বাজানো শুনতেন।

ফ্ল্যামেংকো স্টাইল তার খুব প্রিয় ছিল, প্যাকো ডি লুসিয়া ছিল প্রিয় গিটারিস্ট, অ্যালেক্স স্টুয়ার্ট তার অনেক প্রিয় ছিল। এছাড়া, ক্রসবি স্টিলস ন্যাশ অ্যান্ড ইয়াং, লোবো, বার্কলি জেমস হারভেস্ট, নেইল ইয়াং, সান্টানা, রিচি ব্ল্যাকমোর, ভিনি মুর শুনতেন।

নিও-ক্ল্যাসিক্যাল গিটারের দিকে তার আলাদা মনোযোগ ছিল। আমাদের দেশে নিলয় দাশই প্রথম নিও-ক্ল্যাসিক্যাল গিটারিস্ট বলা যায়। মামস্টেইনের গিটারওয়ার্ক তার পছন্দের ছিল, র‍্যান্ডি রোডস, এরিক জনসন খুব পছন্দ করতেন। তার একটা গিটারে দেখেছি র‍্যান্ডির ছবি লাগানো ছিল। ব্যান্ড হিসেবে পিঙ্ক ফ্লয়েড, ডিপ পার্পল, রেইনবো, ঈগলস ফেভারিট ছিল। কলকাতার ব্যান্ড মহীনের ঘোড়াগুলি পছন্দ করতেন, আর সুমন চট্টোপাধ্যয়ও (কবির সুমন) শুনতেন।

: নিলয় দাশ কি ব্যান্ড করেছিলেন?

মিলু আমান: দুইটা ব্যান্ড তিনি করেছিলেন- একটা 'ট্রিলজি' আরেকটা 'দ্য নোমস'। মাঝে মাঝে দেখছি ব্যান্ডের প্র্যাকটিসে যেতেন। শো করতেন, হোটেলে বাজাতেন। কিন্তু ব্যান্ডের কোনো রেকর্ডিং হয়নি সম্ভবত। ব্যান্ড করা মানে দলগত কিছু বিষয় মেনে চলা, ব্যান্ড মেম্বারদের সঙ্গে নিয়মিত বসা—এগুলো উনি ঠিক মেইনটেইন করতে পারতেন না। এ কারণে হয়তো ব্যান্ড ধরেও রাখা হয়নি। আর নিলয়দা'র মঞ্চভীতি কাজ করত, স্টেজে উঠতে চাইতেন না। অনেকক্ষেত্রেও এমনও হয়েছে যে তাকে জোর করে স্টেজে তুলে দিতে হয়েছে।

 আরেক কিংবদন্তী হ্যাপি আখান্দের সঙ্গে নিলয় দাশের বন্ধুত্বের বিষয়ে জানতে চাই?

মিলু আমান: আমার সঙ্গে নিলয় দাশের পরিচয়ের আগেই হ্যাপি আখান্দ মারা যান। তবে তাদের দুজনের খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিল আমি শুনেছি। নিলয়দা যে গিটারটা আমাকে দেখিয়েছিলেন র‍্যান্ডির ছবিসহ, সেটা হ্যাপি আখান্দের ছিল। ওই গিটারটা উনি রেখে দিয়েছিলেন। আমাকে ওই গিটারের কথা বলতে গিয়ে ইমোশনালও হয়ে গিয়েছিলেন নিলয়দা। বিভিন্ন আড্ডায় হ্যাপির কথা উঠলেই তিনি আবেগী হয়ে যেতেন। হ্যাপির স্মরণে একটা গানও করেছিলেন 'হ্যাপি তোকে মনে পড়লেই, একটা গিটার তোলে ঝংকার'। প্রিয় বন্ধুর নামে তার গিটারের স্কুলের নাম রাখেন, 'হ্যাপি স্কুল অব মিউজিক'।

ডেইলি স্টার: বাংলাদেশের গিটার অঙ্গনে নিলয় দাশ একটা মিথের মতো। এ বিষয়ে আপনার কোনো মন্তব্য...

মিলু আমান: একজন গিটার সাধক ছিলেন নিলয় দাশ, গিটার ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। গিটার ছিল তার লাইফস্টাইলের অংশ। তাকে দেখতে খুবই সাধারণ মনে হতো, কিন্তু গিটারটা হাতে নিলেই 'হি ইজ অ্যা ডিফারেন্ট ম্যান'। কেমন যেন চেহারাটাই তার বদলে যেত। গিটার হাতে তার ভঙ্গি, তার বাজানো পুরোটাই একটা 'মিস্টিক্যাল' ব্যাপার মনে হতো আমাদের কাছে। গিটারের সঙ্গে তার আত্মার সম্পর্ক।

আসলেই নিলয় দাশ একটা মিথ। আমাদের কাছে তো অবশ্যই। কেউ নতুন কিছু বাজাতে পারলে বা কঠিন কোনো মিউজিক তুলে ফেললে বলতাম, দেখো ও তো নিলয়দা'র মতো বাজাচ্ছে।

ডেইলি স্টার: নিলয় দাশকে নিয়ে একটা বই প্রকাশ করেছেন। সেটার পেছনে ভাবনা কী ছিল?

 

মিলু আমান (বামে), সিজারসহ আরও কয়েকজন ভক্ত-ছাত্রদের সঙ্গে নিলয় দাশ। ছবি: মিলু আমানের সৌজন্যে

মিলু আমান: আমি এবং সাংবাদিক হক ফারুক নিলয় দাশকে নিয়ে একটা সংকলন বের করেছিলাম। এটার উদ্দেশ্য ছিল তার মতো একজন গিটারসাধকের স্মৃতি ধরে রাখার। আমার প্রথম বই 'রকযাত্রা'তেও আমি নিলয়দাকে নিয়ে লিখেছিলাম। এরপর হক ফারুককে নিয়ে যখন 'বাংলা রক মেটাল' বই করি তখনই মনে হলো যে নিলয়দাকে নিয়ে একটা বই করব। তখন আমরা নিলয়দা'র কয়েকজন ছাত্র ও কয়েকজন বন্ধু বা তার গানে কাজ করেছেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। পরে ওয়ারফেজের কমল, ফোয়াদ নাসের বাবু, ফুয়াদ ইবনে রাব্বি, সাঈদ করিম, বাবনা, ড্রামার রুমি, নিলয়দা'র এক ছাত্র রাসেল লেখা দিয়েছে। এই লেখাগুলো নিয়েই বইটা প্রকাশ করি।  

 নিলয় দাশকে নিয়ে আপনার প্রিয় কোনো স্মৃতি...

মিলু আমান: পিঙ্ক ফ্লয়েড ছেড়ে যাওয়ার পর রজার ওয়াটার্স একটা কনসার্ট করেছিল 'লাইভ ইন বার্লিন'। ওই কনসার্টের রেকর্ডিং নিয়ে একটা অ্যালবাম বের হয়। আমি সেটা সংগ্রহ করি। ওইসময়ই আমাকে একদিন বললেন যে, নতুন কোনো অ্যালবাম আছে কিনা আমার কাছে। আমি বাসা থেকে ওই 'লাইভ ইন বার্লিন' নিয়ে গেলাম। পেয়ে তো তিনি খুব খুশি। বললেন, 'আরে এটা তো শুনতে চাচ্ছিলাম কয়েকদিন ধরে। যাক তোমার কাছেই পাওয়া গেছে।' আরও বললেন যে, ওই কনসার্টে জেমস গ্যালওয়ে নামে এক বাঁশিবাদক বাজিয়েছেন। ওই বাঁশিবাদক আবার তার খুব প্রিয়। আমার কাছে জানতে চাইলেন যে, আমি জেমস গ্যালওয়েকে চিনি কিনা। আমি চিনি না বলতেই তার সে কি খুশি, আমার সঙ্গে সে কি ঠাট্টা, একদম শিশুর মতোন। এর আগে আমাকে যেটাই জিজ্ঞাসা করেছে জানতে চেয়েছে, সবই বলতে পেরেছি। কিন্তু এই প্রথম আমি জেমস গ্যালওয়েকে চিনি না আর উনি আমার আগে তার বাজানো শুনে ফেলেছেন। বললেন, 'হাহা তোমার আগে আমি শুনে ফেলেছি।'