‘অথচ বুলবুল-সুমনের অভিষেক টেস্ট খেলারই কথা ছিল না’
প্রবাস নিউজ ডেস্কঃ
প্রবাস নিউজ
প্রকাশিত : ১১:২৬ পিএম, ১০ নভেম্বর ২০২৪ রোববার
জাতীয় দলে কখনো খেলেননি। দেশের হয়ে আইসিসি ট্রফি, ওয়ানডে, টেস্ট খেলার স্বপ্নটা স্বপ্নই রয়ে গেছে। তবে খেলোয়াড়ী জীবনে সারোয়ার ইমরান ছিলেন এক ভয়ঙ্কর দ্রুত গতির বোলার। ৮০’র দশকে ম্যাটিং উইকেটে ইমরানকে খেলতে নাভিঃশ্বাস উঠেছে অনেক লদ্ধ প্রতিষ্ঠিত বাঘা বাঘা ব্যাটারের।
ঢাকাই ক্রিকেটে দ্বিতীয় বিভাগ, প্রথম বিভাগ ও সিনিয়র ডিভিশন (এখন যেটা প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগ)- এই তিন লিগে একমাত্র বোলার হিসেবে যার রয়েছে তিন-তিনবার ৮ উইকেট শিকারের দুর্লভ কৃতিত্ব।
কিন্তু ক্রিকেটার সারোয়ার ইমরানের চেয়ে প্রশিক্ষক সারোয়ার ইমরানকেই অনেক বেশি চেনেন সবাই। কারণ খেলোয়াড়ী জীবনের চেয়ে তার কোচিং ক্যারিয়ার অনেক সমৃদ্ধ। অনেক উজ্জ্বল। সফল।
দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে সবচেয়ে সফল কোচের তালিকা করলে এখনো সারোয়ার ইমরানের নামই আসবে সবার আগে। ঢাকা প্রিমিয়ার ক্রিকেটে সর্বাধিক শিরোপাজয়ী কোচ সারোয়ার ইমরান। সবচেয়ে বড় কথা, তিনিই বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টের কোচ।
২০০০ সালের ঠিক আজকের দিনে সারোয়ার ইমরানের কোচিংয়ে টেস্ট অভিষেক হয়েছিল বাংলাদেশের। এরপর বাংলাদেশ দল যখনই সংকটে পড়েছে তখনই ডাক পড়েছে তার। ২০০৩ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে আইসিসির দুই সহযোগী সদস্য কানাডা ও কেনিয়ার কাছে সহ সব খেলায় পরাজিত বাংলাদেশ দলের মাথা তুলে দাঁড়ানোর মিশনের নেপথ্য কারিগরও ছিলেন কোচ ইমরান।
বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টের আগের গল্পটা কেমন? কিভাবে অভিষেক টেস্ট দলের কোচ হয়েছিলেন সারোয়ার ইমরান, প্রথম টেস্টের দল সাজানোর গল্পটাই বা কেমন ছিল? কী লক্ষ্যে প্রথম টেস্ট খেলতে নেমেছিল টাইগাররা?
অভিষেকে সেঞ্চুরি করা আমিনুল ইসলাম বুলবুল আর ৭১ রানের দারুণ ঝকঝকে ইনিংস খেলা হাবিবুল বাশার সুমনের টেস্ট স্কোয়াড ও একাদশে জায়গা পাওয়ার গল্পটাই বা কী? দুই যুগে বাংলাদেশ টেস্টে কতটা উন্নতি করেছে? দেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট সত্যিকার অর্থে কোথায় দাঁড়িয়ে?
আজ ১০ নভেম্বর বাংলাদেশের টেস্ট যাত্রার ২ যুগ পূর্তির দিনে জাগো নিউজের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব বিষয় নিয়ে খোলাখুলি অনেক কথা বলেছেন কোচ সারোয়ার ইমরান।
আসুন শোনা যাক সে সব গল্প...
জাগো নিউজ: ২৪ বছর আগের ঘটনা, আপনি কি মনে করতে পারেন, বলতে পারবেন ঠিক কতদিনের প্রস্তুতি নিয়ে টেস্ট যাত্রা শুরু করেছিল বাংলাদেশ?
সারোয়ার ইমরান: আমরা সেভাবে লংগার ভার্সন ক্রিকেট খেলে বা কোন ভিনদেশি দলের সাথে তিন কিংবা চারদিনের ম্যাচ বেশি খেলে প্রস্তুতি নিতে পারিনি। আমাদের প্রস্তুতির বড় অংশ জুড়ে ছিল আসলে ওয়ানডে ক্রিকেট। যা শুরু হয়েছিল আসলে ২০০০ সালের এশিয়া কাপ থেকে। যেটা ওই বছর মে-জুনে হয়েছিল ঢাকায়।
এরপর সেপ্টেম্বরে আইসিসি নক আউট টুর্নামেন্ট খেলতে কেনিয়া যাই। আইসিসি নক আউটের পর কেনিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যাই।
জাগো নিউজ: তবে কি সবই সীমিত ওভারের ম্যাচ ছিল? প্রস্তুতি পর্বে কোন টেস্ট খেলুড়ে দেশের সাথে বা আঞ্চলিক দলের সাথে কোন তিন বা চারদিনের ম্যাচ খেলেনি বাংলাদেশ?
সারোয়ার ইমরান: হ্যাঁ, খেলেছিতো। কেনিয়ার পর ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে আমরা দক্ষিণ আফ্রিকায় ১টি চারদিনের ম্যাচ ম্যাচ খেলি।
জাগোনিউজ: ওই চারদিনের ম্যাচের ফল কি ছিল?
ইমরান: আমরা হেরেছিলাম। তবে আমার মনে আছে আমরা ভালই খেলেছিলাম। ভাল খেলে লড়াই করেও আমরা হেরে যাই। মূলতঃ দীর্ঘ পরিসরের খেলায় অভিজ্ঞতায় কমতি থাকার কারণেই আমরা ওই চারদিনের ম্যাচটিতে পারিনি। হেরে যাই। উইকেট খুব বাউন্সি ছিল। প্রস্তুতি বলতে আসলে সেটুকুই ছিল।
জাগো নিউজ: অভিষেক টেস্টে আপনিই কোচ হবেন, তা জানলেন কবে? সেটা কবে ঠিক হলো?
ইমরান: আসলে আমাদের প্রধান টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার নামি ক্রিকেট বোদ্ধা এডি বার্লো; কিন্তু তিনি অসুস্থ হয়ে যাবার পর কে কোচ হবে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়।
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসার পর কে অভিষেক টেস্টের কোচ হবে? তা নিয়ে বোর্ডের ভেতরে একটু দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। কারণ সম্ভাব্য হেড কোচ হিসেবে দুটি নাম ছিল, এক আমি আর অন্যজন দিপু রায় চৌধুরী।
সাবেক জাতীয় ক্রিকেটার ও তখন প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগের অন্যতম শক্তিশালি দল কলাবাগান ক্রীড়া চক্রর কোচ। পরে সব কিছু আমার পক্ষে চলে আসে। আমি নির্বাচিত হই। তখনকার বোর্ড সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরীও একদম ফেয়ার ছিলেন। তিনিও আমাকেই কোচ হিসেবে বেছে নেন।
জাগো নিউজ: প্র্যাকটিস হয়েছিল কোথায়?
ইমরান: আসলে তখনতো বিকেএসপি ছাড়া আর কোথাও আবাসিক অনুশীলন করার জায়গা ছিল না। আমাদের অভিষেক টেস্টের প্রস্তুতিটাও বিকেএসপিতেই হয়েছিল।
জাগো নিউজ: যে বছর নভেম্বরে টেস্ট অভিষেক হলো, ঠিক তার আগে একটিমাত্র বছর বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেটাররা চারদিনের জাতীয় লিগ তথা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলার অভিজ্ঞতা নিয়েই টেস্টে যাত্রা শুরু করেছিল, চারদিনের ম্যাচ খেলার প্রচুর ঘাটতি এবং দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেট সম্পর্কে ধারনা ও অভিজ্ঞতা দুই’ই ছিল অনেক কম।
তারপরও ভারতের মত শক্তিশালী দলের বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে ৪০০ রান, আমিনুল ইসলাম বুলবুলের অনবদ্য শতক, হাবিবুল বাশার সুমনের দৃষ্টিনন্দন ও আত্মবিশ্বাসী ৭১ রানের ইনিংস ও অধিনায়ক নাইমুর রহমান দুর্জয়ের ৬ উইকেট- এই এতগুলো ব্যক্তিগত ও দলীয় কৃতিত্ব কি করে সম্ভব হয়েছিল? দল গঠনে আপনার ভূমিকা কতটা ছিল? নির্বাচক ও বোর্ড কর্তারা কি কোচ হিসেবে আপনার মতামত নিয়েই দল সাজিয়েছিলেন? কোচ হিসেবে আপনার ওপর কি কোন চাপ ছিল ?
ইমরান: হ্যাঁ, একটা চাপ ছিল। কোত্থেকে ছিল আমি জানি না। সেটা ওপেন না। তবে ছিল। ভাল মতই ছিল। তাহলো আমিনুল ইসলাম বুলবুলকে বাদ দিতে হবে। টেস্ট খেলানো চলবে না। মানে স্কোয়াডে থাকলেও বুলবুলকে একাদশ থেকে বাদ দিতে হবে? তাকে ১১ জনে নেয়া চলবে না। ওদিকে মিডল অর্ডার থেকে হাবিবুল বাশার সুমন প্রথমে দলেই ছিল না, পরে ঢুকেছে। তা যখন একাদশ চূড়ান্ত করার সময় ঘনিয়ে এলো তখন বোর্ড সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী আমাকে টিম হোটেল শেরাটনে এসে জিজ্ঞেস করলেন, বুলবুল কি খেলবে, না খেলবে না? আপনি কোচ হিসেবে কি মনে করেন?
আমি বললাম, না বুলবুল খেলবে। এতদিন জাতীয় দলকে সার্ভিস দিয়েছে। সে খেলার যোগ্যতা রাখে। অধিনায়ক দুর্জয়ও বুলবুলকে খেলানোর পক্ষেই ছিল। এরপর বুলবুল খেলে। আর শেষ বিপত্তি ও সংশয় দেখা দেয় তিন ওপেনার জাভেদ, বিদ্যুৎ ও অপির মধ্যে কাকে খেলানো হবে, তা নিয়ে। পরে অনেক আলোচনা ও পর্যালোচনার পর জাভেদকে বাইরে রাখা হয়। বিদ্যুৎ আর অপিকে দিয়ে ওপেন করানো হয়। ক্যাপ্টেন ও অন্যান্য অফিসিয়ালসরা বিদ্যুৎ ও অপির পক্ষেই মত দেয়।
জাগো নিউজ: টেস্ট শুরুর আগে ও টেস্ট চলাকালীন কোন স্মরণীয় ঘটনার কথা বলবেন, যা এখনো আপনার মনে দাগ কেটে আছে?
ইমরান: প্র্যাকটিসের সময়ের তেমন কোন ঘটনা মনে নেই। তাই বলা কঠিন। তবে একটা ঘটনা মনে আছে। তা হলো হাবিবুল বাশার সুমন ও এনামুলক হক মনি স্কোয়াড থেকেই বাদ পড়েছিল। মানে তারা অভিষেক টেস্টের দলেই ছিল না। সাবের ভাই (সাবের হোসেন চৌধুরী, সাবেক বিসিবি সভাপতি) আমাকে ডাকেন।
গিয়ে দেখি তখনকার প্রধান নির্বাচক তানভির মামা (তানভির হায়দার) আর অপর নির্বাচক রকিবুল হাসান, তানজিব আহসান সাদ (তখনকার বোর্ড কর্মকর্তা) ও টিম বাংলাদেশ দলের প্রধান উপদেষ্টা এডি বার্লো বসা। সেখানে সুমনকে নিয়ে কথা ওঠে। কারণ টেস্ট দল গড়ার আগে বাংলাদেশ দল যে দক্ষিণ আফ্রিকা ও কেনিয়া খেলতে গিয়েছিল, সেখানে সুমনের ফর্ম ভাল ছিল না। তাই নির্বাচকরা সুমনকে না নেয়ার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করান।
এডি বার্লো অনেক চেষ্টা করেছেন, তবে কোনমতেই সিলেক্টরদের রাজি করাতে পারেননি। আমিও সুমনের পক্ষে তেমন জোর দিয়ে কিছু বলতে পারিনি। নির্বাচকদের যুক্তিগুলো অগ্রাহ্য করার মত ছিল না। যুক্তিযুক্তই ছিল। এরপর মনি বাদ পড়লো। সাবের হোসেন চৌধুরী আমাকে আলাদা ডেকে কথা বলেন, সুমন কেমন প্লেয়ার? আপনারা যে সুমনকে বাদ দিলেন, এডি বার্লোতো মনে করেন যে সুমন বাংলাদেশের বেস্ট প্লেয়ার।
আমি বললাম নাহ সুমনতো ভাল প্লেয়ার। লাস্ট দুটি সফরে খারাপ খেলেছে। তখন সাবের ভাই আমাকে বললেন আপনি কি মনে করেন? সুমনকে কি রাখা যায়? আমি বললাম হ্যাঁ, রাখা যায়। সুমনতো প্লেয়ার ভাল। আমাদের দেশেই যেহেতু খেলা, আমরা স্কোয়াডে ১৪ জনের বদলে ১৬ জন ক্রিকেটার রাখতে পারি।
এরপর সাবের ভাই নির্বাচকদের সাথে কথা বলে সুমনকে স্কোয়াডে রাখেন এবং পরবর্তীতে সুমন একাদশেও জায়গা পায়। সেটা আমার ইচ্ছেতেই। দুই নম্বর হলো, বুলবুলের সেঞ্চুরি আর দুর্জয়ের ৬ উইকেট আমাকে আনন্দ দেয়। দুর্জয় বিকেএসপিতে আমার প্রথম ব্যাচের ছাত্র। তাই তার সাফল্যটাও আমার মনে দাগ কেটে আছে।
জাগো নিউজ: দেশের প্রথম টেস্ট। তাও ভারতের বিপক্ষে। আপনাদের লক্ষ্য ও পরিকল্পনা কি ছিল?
ইমরান: আমাদের কথা ছিল, আমাদের মাঠ, আমাদের উইকেট। এ মাঠে আমরা অনেকদিন ধরে খেলছি। সবই আমাদের চেনা। জানা। বোঝা। আমরা ব্যাটিং করলে নির্দিষ্ট কোন স্কোর নয়, আমরা যত বেশি সম্ভব বল খেলবো। আর যতক্ষণ সম্ভব উইকেটে থাকার চেষ্টা করবো। উইকেটও খুবই ভাল ছিল।
জাগো নিউজ: বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসের কিছু ঘটনা কি মনে আছে?
ইমরান: হ্যাঁ, দুটি ইনিংসের কথা আমি কোন দিন ভুলবো না। অবশ্যই একটি হলো বুলবুলের অবিস্মরনীয় সেঞ্চুরি। আমি কেন, বাংলাদেশের প্রতিটি ক্রিকেট অনুরাগির মনেই ওই শতরানের ইনিংসটি চির স্মরণীয় হয়ে আছে। বুলবুলের শতকটি ছিল দায়িত্বশীলতার প্রতীক। ধৈর্য্য, মনোযোগ ও মনোসংযোগে সাজানো প্রকৃত টেস্ট ইনিংস।
কিন্তু আমার কাছে হাবিবুল বাশার সুমনের ৭০ প্লাস ইনিংসটি এখনো মনে দাগ কেটে আছে। দেখার মত ইনিংস খেলেছিল সুমন । খুব অ্যাটাকিং ছিল। সুমনের ওই আত্মবিশ্বাসী, সাহসী, সাবলীল ও আক্রমণাত্মক ব্যাটিং পরবর্তী ব্যাটারদের অনেক সাহস বাড়িয়ে দিয়েছিল। পুরো ড্রেসিং রুমকে অনুপ্রাণিত করে তুলেছিল। আমাদের নীচের দিককার ব্যাটাররা ভাল করতে পারেনি। তাহলে আরও বড় ইনিংস হতে পারতো।
জাগো নিউজ: প্রথম ইনিংসে ৪০০ রান করার পরও দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৯১ রানে গুঁড়িয়ে শেষ পর্যন্ত ৯ উইকেটে হরের করুণ পরিণতি বরণ করতে হয়েছিল বাংলাদেশ দলকে। আপনার কি মনে হয়, দারুন সূচনার পরও অত বাজেভাবে হারের কারণ কী? উইকেট কি বোলারদের পক্ষে চলে গিয়েছিল?
ইমরান: না, না। আমাদের প্রথম ইনিংসে বেশি ভাল খেলা ও ৪০০ রান করাটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমাদের দলের ড্রেসিং রুমটা একটা বাজার হয়ে পড়েছিল। যে পারতো সেই ঢুকে পড়ছিল ড্রেসিং রুমে। মন্ত্রী (ক্রীড়া মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের) থেকে শুরু করে বোর্ডের কর্তা ও ক্রিকেটাঙ্গনের অনেকেরই অবাধ যাতায়াত শুরু হলো ড্রেসিংরুমে।
আমি নিজেই ঢুকতে পারছিলাম না। একটু পরপর আসে। এর ওর সাথে কথা বলে। আমি কোচ হয়েও তাদের অবাধ অনুপ্রবেশে বাধা দিতে পারিনি। দলের বাইরের মানুষ-জনের অবাধ ড্রেসিং রুমে ঢোকা, প্লেয়ারদের সাথে খোলামেলা কথা-বার্তায় ক্রিকেটারদের মনেযোগ, মনোসংযোগ অন্যদিকে চলে গিয়েছিল।
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, দলের বাইরে থাকা বোর্ড কর্মকর্তা, মিডিয়ার কারো কারো কারো ধারণা ছিল যে, আমরা ওই টেস্ট জিততে পারি। টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৪০০ রান করে কিন্তু টেস্ট জেতা যায় না, আরও অনেক কিছু বাকি থাকে। খেলাটা ৫ দিনের। আরও কতগুলো সেশন বাকি, আরও অনেক কিছুই ঘটতে পারে।
এসব ধারণাই ছিল না কারো। একটা অপেশদার আচরণ ছিল সবার মনে। মোটকথা, অনেকেরই ধারণা ছিল না, টেস্ট ক্রিকেট মানেই সেশন বাই সেশন খেলা। আমরা যে প্রথম ইনিংসে ৪০০ করেও হারতে পারি, তা অনেকের মাথাতেই আসেনি। সেই অনভিজ্ঞতা আর আনাড়ি মার্কা আচরণের কারণেই আমাদের সেকেন্ড ইনিংস পুরো কলাপ্স করেছিল বলে আমার মনে হয়। আমরা মনে হয় ৯০ না ৯১’তে (৯১) অলআউট হয়ে ম্যাচ হারি। অভিজ্ঞতা ছিল না বলেই এমন হয়েছিল।
জাগো নিউজ: আপনার কি মনে হয় প্রথম ইনিংসে ৪০০ রান করার পর ভারতের প্রথম ইনিংস ৪২৯ রানে শেষ করার পর বাংলাদেশ শিবির, ভক্ত, সমর্থক ও বোর্ড কর্মকর্তা- সবার মাঝে একটা অতি উৎসাহী মানসিকতা তৈরি হয়?
ইমরান: হ্যাঁ, একদম তাই। সবাই অতি উৎসাহী হয়ে পড়েন। ভাবটা এমন আমরা এ টেস্ট ম্যাচ জিতেও যেতে পারি।
জাগো নিউজ: শেষ পরিণতি যাই হোক, অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৪০০ রান করা, বুলবুলের শতক, হাবিবুল বাশার সুমনের দুর্দান্ত ৭২ রান, অধিনায়ক নাইমুর রহমান দুর্জয়ের ৬ উইকেট- সেই বাংলাদেশ দলের আজ ২৪ বছর পরও টেস্টে খাবি খায়, এখনো ২০০ রান করতে নাভিশ্বাস ওঠে। আড়াই দিন, তিনদিনে টেস্ট হেরে যায়, আপনার কেমন লাগে? আপনি কতটা হতাশ?
ইমরান: আমি পুরোপুরিই হতাশ। আমাদের আজকে যেখানে থাকা উচিৎ ছিল, আমাদের যতটা আগানো দরকার ছিল, তার কিছুই হয়নি। আমরা সেভাবে আগাতে পারিনি। টেস্টে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য উন্নতিই হয়নি আমাদের। সে জন্য কেউ একা নয়, আসল গলদ আমাদের সিস্টেমে।
শুরুর দিকে একটা অ্যাডভান্টেজ ছিল যে আমাদের দলের দুই অভিজ্ঞ ব্যাটার বুলবুল ও আকরাম টেস্টে নতুন হলেও ক্রিকেটার হিসেবে ছিল একদম পরিণত। অভিজ্ঞ। তাদের জাতীয় লিগ, জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে তিনদিনের ম্যাচেও অনেক সেঞ্চুরি ছিল এবং তাদের লম্বা ইনিংস খেলার সামর্থ্য ছিল। অভ্যাসও ছিল।
সাথে রোকন, দুর্জয় ও রফিক, পাইলটরা ছিল অনেক এক্সপেরিয়েন্স পারফরমার। যেটা আমাদের এখনকার ক্রিকেটারদের মধ্যে অনেক কম। এখনকার টেস্ট ক্রিকেটারদের বেশিরভাগ প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেই খুব কম। আমাদের বর্তমান প্রজন্মের অনেক টেস্ট প্লেয়ার প্রথম শ্রেণির ম্যাচই খেলে না; কিন্তু দেশে ও বিদেশে টেস্ট খেলে। যে কারণে তাদের টেস্ট ব্যাটিং ও বোলিং করার সামর্থ্যই তৈরি হয়নি। তরুণ প্রজন্মের ব্যাটারদের লম্বা সময় উইকেটে থাকার মানসিকতা কম। ধৈর্য্য, মনোযোগ ও মনোসংযোগে ঘাটতি প্রচুর। এখানে সিস্টেমেও প্রচুর ঘাটতি।
সবাই মুখে বলে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট হলো এক নম্বর, তারপর হলো অন্য আসর বা লিগ; কিন্তু বাস্তবে তা নেই। সেটা আছে মুখে মুখে। আমি যতগুলো প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে কোচিং করিয়েছি, তাতে আমি কোন দর্শক মাঠে দেখিনি। শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশদের দেখেছি।
বিপিএলকে পিছনে ফেলতে হলে জাতীয় লিগ ও বিসিএলেও মনোযোগী হতে হবে। অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হবে। প্রচার-প্রসার বাড়াতে হবে। জৌলুস, আকর্ষণ বাড়ানোর প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো বাড়াতে হবে। তবেই জাতীয় লিগ, বিসিএল তথা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের আকর্ষণ ও জৌলুস বাড়বে।
যেভাবে বিপিএল ও ঢাকার প্রিমিয়ার লিগে অর্থ লগ্নি করা হয়, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও তেমন করতে হবে। ভারতে দেখেন শুধু নিয়ম মেনেই সবাই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট, রঞ্জি ট্রফিসহ সব ক্রিকেট আসরে অংশ নেয় না। ওই সব আসর খেলে প্রচুর অর্থও পায়। আমাদের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ওই পরিমাণ অর্থ কল্পনাও করা যায় না। পিচের অবস্থাও তেমন না। পিচের স্ট্যান্ডার্ড আরও বাড়াতে হবে।
মোট কথা, টেস্ট ক্রিকেটে ভাল খেলতে হলে দরকার উন্নত, আকর্ষণীয় ও প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ জমজমাট প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট। আর আমরা আছি বিপিএল ও প্রিমিয়ার লিগকে আকর্ষণীয় করতে। তাহলে আর টেস্ট ক্রিকেটের প্রতি ক্রিকেটারদের উৎসাহ ও আগ্রহ বাড়বে কী করে?